যাকাত কী? কোন সম্পদের যাকাত দিতে হয়? যাকাত প্রদানের খাত কয়টি?

যে সম্পদের জাকাত দিতে হবে

যাকাত কাকে বলে?

ইসলামের পাচঁটি স্তম্ভ রয়েছে। তার মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাত একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া; বেশি হওয়া ইত্যাদি। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহান আল্লাহ যেখানেই সালাতের কথা বলা বলেছেন, সেখানেই পর পর যাকাতের কথা বলেছেন। প্রবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, “অর্থাৎ, তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর।” সুতরাং যাকাত আদায়ের কি গরুত্ব সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইসলাম ধর্ম মতে, কোন নর বা নারীর যদি প্রতি বছরের আয় ও সম্পদ ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে অর্থ্যাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে ওই আয় বা সম্পদের একটি অংশ গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলে। যে নর বা নারীর নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তার উপর যাকাত দেওয়াকে ফরজ করা হয়েছে। সম্পদের পরিশুদ্ধি ও অসহায় ও গরীব দুঃখী মানুষের মাঝে স্বচ্ছলতা ফেরানো, দারিদ্র বিমোচন যাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য। যাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং তোমরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য জাকাত আদা‘য় করো। অত:পর তিনি তা দ্বীগুণ করে দেবে‘ন। (সুরা: আর-রুম,আয়াত : ৩৯)

এছাড়া, সূরা তাওবাহ-তে তিনি বলেছেন- “তাদের মালামা‘ল থেকে জাকাত গ্রহ‘ণ করুন যাতে তার মাধ্য‘মে তাদের‘কে পবিত্র ও পরিচ্ছ‘ন্ন করতে পারেন। আর তাদের জন্য দোয়া করুন; নি:সন্দেহে আপনা‘র দোয়া তাদের জন্য স্বান্ত্বনাস্বরূপ। বস্তুত: আল্লাহ সবকিছু শোনে‘ন, জানেন। (সূরা তাওবাহ : আয়াত ১০৩)

তাহলে কোন কোন সম্পদ বা জিনিসের যাকাত দিতে হয়? কি পরিমাণ সম্পদ হলে যাকাত দিতে হয়; তা জানা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। আজকের পোস্টে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তাহলে চলুন শুরু করা যাক…

 

আরও পড়ুন:

যে জিকিরে ঈমান তাজা হয়

দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির দোয়া

যাদের যাকাত দেওয়া যাবে

যারা যাকাত নিতে পারবে-
জাকাতের সম্পদ ব্যয়ের খাত মোট ৮টি। অর্থ্যাৎ আট শ্রেণীর মানুষ জাকাত গ্রহন করতে বা নিতে পারবে। সেগুলো হলো-

  • গরিব-ফকির— যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয় তারা যাকাত গ্রহন করতে পারবে।
  • মিসকিন— যাদের কোন ধন-সম্পদ নেই। তারা যাকাত গ্রহন করতে পারবে।
  • ইসলামি রাষ্ট্রের সরকারকর্তৃক যাকাত, সদকা, ওশর ইত্যাদি উসুল করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্ত গ্রহন করতে পারবে।
  • কোন ব্যক্তিকে ইসলামের দিকে ধাবিত করার জন্য যাকাত প্রদান করা যাবে। তবে বর্তমানে এ খাতটি প্রযোজ্য নয়।
  • নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ কোন দাস-দাসী যাকাত গ্রহন করতে পারবে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধে অক্ষম ঋণী ব্যক্তি যাকাত গ্রহন করতে পারবে।
  • যোদ্ধা, যারা যুদ্ধের অস্ত্র যোগাতে অক্ষম অথবা টাকার কারণে পবিত্র হজের কাজ পূর্ণ করতে অক্ষম অথবা ইলম হাসিল ও দ্বীনি দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত গরিব মানুষ যাকাত গ্রহন করতে পারবে।
  • সফর অবস্থায় অভাবগ্রস্ত কোন ব্যক্তি যাকাত গ্রহন করতে পারবে।

 

 

যে সম্পদের জাকাত দিতে হবে

মহান আল্লাহ তা’লা যাকাতের যে বিধান করেছেন তা ৩ ধরণের। সেগুলো হলো-

প্রথম- সম্পদের জাকাত-
১. স্বর্ণ-রূপা ও সকল মুদ্রার যাকাত।
২. উট, গরু, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল প্রভূতি যেসব প্রাণী মুক্তভাবে বিচরণ করে।
৩. জমিন থেকে যা বের হয়। যেমন- শস্যদানা, ফল-ফলাদি ও খনিজপদার্থ।
৪. ব্যবসা সামগ্রী।

দ্বিতীয়- ব্যক্তি দায়িত্বের ফরজ যাকাত। যা প্রতি রমজানের শেষে ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বে আদায় করতে হয়। অর্থাৎ সাদাকাতুল ফিতর।

তৃতীয়- উত্তম দান খয়রাত। যা মহান আল্লাহর কাছে বেশি সওয়াবের আশায় কোন মুসলিম ব্যক্তি দান করে থাকে।

 

স্বর্ণ-রূপার যাকাতের পরিমাণ (২.৫০%)

স্বর্ণের পরিমাণ: কোন ব্যক্তির স্বর্ণ বিশ দিনার ও এর অতিরিক্ত হলে শতকরা ২.৫০% হারে যাকাত দিতে হবে। গ্রামের হিসাবে ২০ দিনার সমান হবে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ। যা ভরির হিসাবে সাড়ে ৭ তোলা বা ভরি।

রূপার পরিমাণ: রূপা দুই শত ও এর অধিক সংখ্যা দিরহাম হলে বা ওজনে পাঁচ আওয়াক ও এর অতিরিক্ত হলে ২.৫০ হারে যাকাত দিতে হবে। এই হিসাবে ২ শত দিরহাম সমান ৫৯৫ গ্রাম। যা ভরির হিসাবে সাড়ে ৫২ তোলা বা রূপা হয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বর্ণ ও রূপা এক সাথে মিলানো যাবে না। আলাদা আলাদা হিসাব করতে হবে।

দিনার: এক দিনার (স্বর্ণমদ্রা) সমান হচ্ছে ১ মিছকাল। আর ১ মিছকাল বর্তমান যুগের হিসাবে ৪.২৫ গ্রাম।

 

মুদ্রাসমূহের যাকাত-

মুদ্রার বিধান (রিয়াল, ডলার, টাকা) স্বর্ণ-রূপার মতোই। কিমাত তথা বর্তমান মূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। মুদ্রার পরিমাণ যখন স্বর্ণের বা রূপার মূল্যের সমপরিমান নিসাবে পৌঁছবে তখন স্বর্ণ-রূপার মূল্যের হারে যাকাত দিতে হবে।

 

মুদ্রার যাকাত বের করার পদ্ধতি

ধরা যাক, কোন ব্যক্তির সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ রয়েছে। বর্তমানে ১ ভরি স্বর্ণের দাম ৫০,০০০/- টাকা। তাহলে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণের দাম হবে ৩,৭৫,০০০/- টাকা। যার নিকট সর্ব নিম্ন এই পরিমাণ টাকা থাকবে, তাকে ২.৫০% হারে আদায় প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ তাকে ৯,৩৭৫/- টাকা যাকাত দিতে হবে।

 

উট, গরু, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল-এর যাকাতের দুটি অবস্থা। যথা-

ক) যখন পশুগুলো একটি পূর্ণ বছর বা অধিকাংশ সময় বৈধ মরুভূমি অথবা খোলা মাঠে কিংবা চারণভূমিতে মুক্তভাবে বিচরণ করবে। বছর পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নির্ধারিত নিসাবে পৌঁছবে তখন তাতে যাকাত ফরজ হবে। যাকাত দেয়ার সময় সর্বোত্তম বা সর্বনিম্ন মানের পশুটি নেয়া যাবে না। বরং মধ্যমটি গ্রহণ করতে হবে।

খ) যদি কোন পশুর খাদ্য নিজের বাগান থেকে অথবা কিনে ব্যবস্থা করা হয় এবং ব্যবসার নিয়্যতে ক্রয় করে আর তার উপর এক বছর অতিবাহিত হয় তবে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে ২.৫০% হারে যাকাত দিতে হবে। তবে, ব্যবসার জন্য না হয়ে যদি দুধ ও বাচ্চা দেয়ার জন্য হয় এবং পশু খাদ্যের ব্যবস্থা মালিককে করতে হয় তাহলে কোন যাকাত দিতে হবে না।

 

পশুর নিসাব

১) মেষ (দুম্বা-ভেড়া) ও ছাগলের সর্বনিম্ন নিসাব হচ্ছে ৪০ টি। অর্থ্যাৎ কোন ব্যক্তির ৪০ থেকে ১২০টি মেষ (দুম্বা-ভেড়া) কিংবা ছাগল থাকলে ১ মেষ বা ছাগলের যাকাত দিতে হবে। যদি ১২১ থেকে ২০০টি হয় তাহলে ২টি মেষ বা ছাগল যাকাত দিতে হবে। যদি ২০১ থেকে ৩৯৯ টি হয় তাহলে ৩টি মেষ বা ছাগল যাকাত দিতে হবে। এরপর প্রতি শ’তে একটি করে চলতে থাকবে।

২) গরুর সর্বনিম্ন নিসাব হচ্ছে ৩০ টি । অর্থ্যাৎ কোন ব্যক্তির ৩০-৩৯ গরু থাকলে ১ বছরের একটি গরু যাকাত দিতে হবে। ৪০-৫৯ হলে ২ বছরের গরু যাকাত দিতে হবে। ৬০-৬৯ হলে ২টি ১ বছরের গরু; ৭০-৭৯ হলে ২ বছরের ১ গরু ও ১ বছরের একটি গরু যাকাত দিতে হবে। এরপর প্রতি ৩০টিতে একটি গরু ; এবং প্রতি ৪০টিতে ২ বছরের একটি বেটি বাছুর। ৫০টি গরুতে ২ বছরের ১ বেটি বাছুর; ৭০ গরুতে একটি ১ বছরের বেটা বা বেটি বাছুর ও ২ বছরের একটি বেটি বাছুর এবং ১০০ টি গরুতে ২টি ১ বছরের বেটা বা বেটি বাছুর ও ১টি ২ বছরের বেটি বাছুর। আর ১২০টি গরুতে ৪টি ১ বছরের বেটি বাছুর অথবা ৩টি ২ বছরের বেটি বাছুর। গরুর জাকাতের হিসাব এভাবেই চলতে থাকবে।

৩) উটের সর্বনিম্ন নিসাব হচ্ছে সর্বনিম্ন ৫টি-

  • ৫টি থেকে ৯টি উট থাকলে ১টি ছাগল যাকাত দিতে হবে।
  • ১০টি থেকে ১৪টি উট থাকলে ২টি ছাগল যাকাত দিতে হবে।
  • ১৫টি থেকে ১৯টি উট থাকলে ৩টি ছাগল যাকাত দিতে হবে।
  • ২০টি থেকে ২৪ টি উট থাকলে ৪টি ছাগল যাকাত দিতে হবে।
  • ২৫টি ৩৫টি এক বছরের (বিনতে মাখাজ) উট থাকলে একটি উষ্ট্রী।
  • ৩৬টি থেকে ৪৫টি উট থাকলে ২ বছরের একটি উষ্ট্রী (বিনতে লাবূন)।
  • ৪৬টি থেকে ৬০টি উট থাকলে (হিক্কাহ) ৩ বছরের একটি উষ্ট্রী।
  • ৬১টি থেকে ৭৫টি উট থাকলে(জিয্আ) ৪ বছরের উষ্ট্রী।
  • ৭৬টি থেকে ৯০টি উট থাকলে ২টি বিনতে লাবূন (২ বছরের দু’টি উষ্ট্রী)।
  • ৯১টি থেকে ১২০টি উট থাকলে ২টি হিক্কাহ (৩ বছরের ২টি উষ্ট্রী)।

(যেহেতু আমাদের দেশে এত সংখ্যক উট হয় না সেহেতু উটের যাকাত নিসাব এটুকুই রাখছি)।  

 

 

জমিন থেকে যা বের হয়; শস্যদানা, ফল ও খনিজপদার্থের যাকাত

শস্যদানা ও ফলাদির জাকাত ফরজের শর্তসমূহ-
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে এবং যাকাত দেওয়ার সময় মালিকানাভুক্ত হতে হবে।
নিসাব হচ্ছে ৫ ওয়াসাক। ১ ওয়াসাক সমান ৬০ সাআ। তাহলে ৫ * ৬০= ৩০০ সাআ।
১ সাআ উত্তম গমের মাপ হয় প্রায় ২.৪০ কেজি। তাহলে ৩০০ * ২.৪০=৬১২ কেজি নিসাব।
একই প্রকারে ফল-ফলাদি হলে যেমন খেজুর এক বছরের সমস্ত ফল নিসাব পূরণের জন্য একত্র করতে হবে।

হাদিসে এসেছে-
রাসুল (সা) বলেছেন, ‘৫ আওয়াকের কমে যাকাত নেই। ৫টি উটের কমে জাকাত নেই। পাঁচ ওয়াসাকের কমে যাকাত ফরজ নেই।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

১) উশর একদশমাংশ (১০%): ইহা বিনা খরচে উৎাদিত হলে যেমন : বৃষ্টির পানি বা ঝর্ণার পানি দ্বারা।

২) অর্ধেক উশর একবিশমাংশ (৫%): ইহা সেচ দ্বারা উৎপাদিত হলে। যেমন- কুপের বা গভীর নলকূপ কিংবা পুকুর বা নদীর পানি মেশিন ইত্যাদি দ্বারা সেচ দিয়ে উৎপাদিত ফসল বা ফল।

জাকাত ফরজের সময়

—শস্যদানা ও ফল-ফলাদি শক্ত বা পেকে গেলে তখন যাকাত ফরজ হবে। ফল পাকা মানে হলো ফল লাল বা হলুদ হয়ে যাওয়া।

সুতরাং বিক্রেতা যদি এর পরে বিক্রি করে তাহলে যাকাত বিক্রেতার উপর ফরজ হবে ক্রেতার ওপর নয়।

— যদি মালিকের অবহেলা ও ত্রুটি ব্যতীত কোন ফসল নষ্ট হয়ে যায় তাহলে যাকাত ফরজ হবে না।

— যে সকল সবজি ফল-ফলাদি গুদামজাত করা যায় না তার ওপর কোনো যাকাত নাই। কিন্তু যদি সেটা ব্যবসা সামগ্রী হয় এবং তার বিক্রি মূল্যে বছর অতিক্রম ও নিসবা পরিমাণ হয় তাহলে শতকরা ২.৫০% হারে যাকাত দিতে হবে।

 

ব্যবসা সামগ্রী

কেনা-বেচার জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রীকে “উরুযুত্তিজারা” বলে। যেমন- স্থাবর সম্পত্তি, পশু, খাদ্য ও মেশিনপত্র ইত্যাদি।

ব্যবসা সামগ্রীর জাকাতের বিধান-

ব্যবসা সামগ্রী যখন নিসাবে পৌঁছাবে ও তার প্রতি এক বছর অতিক্রম হবে তখন তার ওপর যাকাত ফরজ হবে। বছর পূর্ণ হলে স্বর্ণের বা রূপার যে নিসাব যাকাতের হকদারদের জন্য বেশি উপকারী সে হিসাবে সমস্ত বিক্রয় মূল্য অথবা ব্যবসা সামগ্রী থেকে শতকরা ২.৫০% হারে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে।

মহান আল্লাহ তা’লা আমাদের সকলকে নিয়ম মেনে যাকাত দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

##########

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button