সাংবিধানিক সরকার কি বা কাকে বলে? সাংবিধানিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও সমস্যা

সাংবিধানিক সরকার কি বা কাকে বলে?

একটি রাষ্ট্রের দিক নির্দেশক হচ্ছে সংবিধান। এর মাধ্যমে সরকারের রূপ নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ যে কোন ধরনের সরকারের উৎস হচ্ছে সংবিধান।

তাই বলা যায়, সংবিধান সরকারের সৃষ্টি নয়, বরং সরকারই সংবিধানের সৃষ্টি। আর এ থেকেই সাংবিধানিক সরকারের ধারণার উৎপত্তি।

সাংবিধানিক সরকারের ধারণা আজ নতুন কিছু নয়। প্রাচীনকালের গ্রীক নগররাষ্ট্র থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাংবিধানিক সরকারের বিকাশের ধারা অব্যাহত গতিতে চলে আসছে। আধুনিক বিশ্বে সাংবিধানিক সরকারকে উত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সরকার বলে অভিহিত করা হয়।

 

সাংবিধানিক সরকারের সংজ্ঞা (Definition of Constitutional Government)

সাধারণ অর্থে সংবিধানের প্রতি অনুগত বা সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত সরকারকে সাংবিধানিক বলে।

প্রকৃতপক্ষে, সাংবিধানিক সরকার বলতে দেশের সরকারের উপর কার্যকর সাংবিধানিক বিধিনিষেধ আরোপের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাকে বুঝায়। তবে শুধু সংবিধান থাকলেই একটি দেশের সরকারকে সাংবিধানিক সরকার বলা যায় না। কারণ সংবিধান যদি সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন সীমাবদ্ধতা আরোপ না করে তাহলে সে সরকার সাংবিধানিক সরকার হতে পারে না। সাংবিধানিক সরকারের প্রকৃত অর্থই হচ্ছে এটি আইনের দ্বারা পরিচালিত সরকার, ব্যক্তির ইচ্ছাধীন সরকার নয়। সাংবিধানিক সরকারের ক্ষমতা সীমিত থাকায় এ সরকারকে ‘সীমাবদ্ধ সরকার’ (Limited Government )-ও বলা হয় ।

আরও পড়ুন:

সাম্য কাকে বলে? কত প্রকার ও কী কী? সমাজ জীবনে সাম্যের গুরুত্ব

সংবিধান কাকে বলে? বাংলাদেশের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য

সাংবিধানিক সরকারের সংজ্ঞায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (Woodraw Wilson)- বলেন, “ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য যে সরকার তার ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে, সেই সরকারকেই সাংবিধানিক সরকার বলা হয়।”

উইলোবী (Willoughby) বলেন, “আইনের অনুগত ও আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ সরকারকে সাংবিধানিক সরকার বলে।”

অধ্যাপক কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare)-এর মতে, “সাংবিধানিক সরকার কেবলমাত্র সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সরকার নয়। এটা এক প্রকার আইনানুগ সরকার এবং সংবিধানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত; যারা সরকারি ক্ষমতা কার্যকরী করে তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।”

সুতরাং সাংবিধানিক সরকার বলতে সেই সরকার ব্যবস্থাকে বুঝায় যা কোন ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং আইনের দ্বারা পরিচালিত ব্যবস্থা যেখানে দেশের জনগণের স্বাধীনতা ও ইচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে থাকে।

 

সাংবিধানিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of Constitutional Government)

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেরই একটি সংবিধান রয়েছে। কিন্তু সংবিধান থাকলেই কেবল সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। কোন সরকার সাংবিধানিক কি না তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড বা বৈশিষ্ট্যাবলির পর্যালোচনার প্রয়োজন সেগুলো নিম্নরূপ:

  • ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: সাংবিধানিক সরকারের কার্যাবলি ও ক্ষমতা সাংবিধানিক নিয়মকানুন এবং জনমতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ। সরকার তার ক্ষমতা ইচ্ছামত বৃদ্ধি করতে পারে না। এরূপ সরকারকে তাই সীমাবদ্ধ সরকার বলা হয়।

আরও পড়ুন:

স্বাধীনতা কী বা কাকে বলে? স্বাধীনতার সংজ্ঞা? স্বাধীনতা কত প্রকার ও কী কী?

আইন কি বা আইন কাকে বলে? আইনের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও উৎস কী?

  • ব্যক্তির সরকার নয়: সাংবিধানিক সরকার রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং এটি কতকগুলো সম্পষ্ট নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত: যেগুলো রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং যাদের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ দিক থেকে সাংবিধানিক সরকার ব্যক্তিগত সরকার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ।

 

  • আইনের সরকার: সাংবিধানিক সরকার আইনের সরকার, জনগণের সরকার নয়। এ সরকারকে আইনের প্রতি অবিচল আনুগত্য প্রদর্শন করে চলতে হয়। সাংবিধানিক সরকারে আইনের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়।

 

  • শাসন পদ্ধতির স্থিতিশীলতা: সাংবিধানিক সরকারের কার্যপদ্ধতির স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। এসব পদ্ধতির ঘন ঘন বা ব্যক্তিগত খেয়ালখুশিমত রদবদল করা যাবে না। তাছাড়া যেসব কাজ সংবিধানসম্মত বলে গণ্য হচ্ছে তা হঠাৎ করে সংবিধান বিরোধী বলে গণ্য হবে না।

 

  • জনগণের অংশগ্রহণ: সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থায় জনগণ সাংবিধানিকভাবে সরকারি কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারে। তা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে হতে পারে অথবা প্রত্যক্ষভাবে হতে পারে ।

 

  • সংবিধানের প্রাধান্য: সাংবিধানিক সরকারের ক্ষেত্রে সংবিধানের প্রাধান্য বজায় রাখা হয়। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ ও মৌলিক আইন বলে গণ্য হয়। সংবিধানই সাংবিধানিক সরকারের মূল নিয়ন্ত্রক ও রক্ষাকবচ। এ সংবিধানের বিরুদ্ধে বা এর বাইরে সরকারের কোন এখতিয়ার থাকবে না। বিচার বিভাগ সাংবিধানিক প্রাধান্য রক্ষার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখে।

 

  • ভারসাম্য: সাংবিধানিক সরকার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ভারসাম্যের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এ ভারসাম্য রক্ষা করা অবশ্যম্ভাবী নয়। সরকার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে এ সকল বিভিন্ন স্বার্থকামী গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন করে।

 

  • প্রকাশ্যতা: প্রকাশ্যতা সাংবিধানিক সরকারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ সরকারে সরকারি বিষয়সমূহ প্রকাশ্যে পরিচালিত হয়, গোপনে নয় । জনগণ সরকারি কার্যক্রম সম্বন্ধে সব সময় অবহিত থাকে ।

 

  • বিচার বিভাগের প্রাধান্য: বিচার বিভাগের প্রাধান্য সাংবিধানিক সরকারের অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে তা সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা নির্ধারণ করে । তাই বিচার বিভাগকে Guardian of the Constitution বলা হয়।

 

  • মৌলিক অধিকার: জনগণের মৌলিক অধিকার এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সাংবিধানিক সরকারের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটা শুধুমাত্র নির্বাহী বিভাগের স্বৈরাচারী ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে না, বরং এটা আইন বিভাগের অন্যায় আচরণ এবং জনস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

 

  • স্বাভাবিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর: স্বাভাবিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর সাংবিধানিক সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাংবিধানিক নিয়মনীতির মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে।

 

  • গণতান্ত্রিক সরকার: সাংবিধানিক সরকার মূলত স্বৈরতন্ত্র বিরোধী ও গণতান্ত্রিক সরকার। এ সরকার জনগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এরূপ সরকার সংবিধানের আলোকে পরিচালিত হয় বলে তা স্বৈরাচারী হতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণে সাংবিধানিক সরকার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালায়।

আরও পড়ুন:

পরিবার কাকে বলে? পরিবারের শ্রেণিবিভাগ এবং পরিবার কত প্রকার?

যৌথ পরিবার কাকে বলে? যৌথ পরিবারের সুবিধা ও অসুবিধা

  • ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: নিয়মতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় অবশ্যই ক্ষমতা জাতীয় এবং আঞ্চলিক সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। সকল ক্ষমতা কোন একটি বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলে সে বিভাগের কার্যত কোন বাধানিষেধ থাকে না। কেননা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা অধিকাংশ সম স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়।

 

  • দায়িত্বশীলতা: দায়িত্বশীলতা সাংবিধানিক সরকারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেননা সাবধান সরকার সবসময় জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থেকে জনস্বার্থের অনুকূলে শাসনকার্য পরিচালনা করে।

 

  • সুনির্দিষ্ট শাসন পদ্ধতি: সাংবিধানিক সরকার পরিচালিত হয় সাংবিধানিক আইন দ্বারা, ব্যক্তিগত খেয়ালখুশিমত নয়। সাংবিধানিক সরকারের গঠন পদ্ধতি, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সংবিধানে সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত থাকে।

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এই প্রতীয়মান হয় যে, সাংবিধানিক সরকার হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার। গণতন্ত্রই এ সরকারের অপরিহার্য শর্ত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা এ সরকারের প্রধান লক্ষ্য । বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি উন্নত দেশে সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে সাংবিধানিক সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

 

সাংবিধানিক সরকারের সমস্যা (Problems of Constitutional Government)

আধুনিক যুগে সাংবিধানিক সরকার সব দেশেই কাম্য হলেও এরূপ সরকারের জন্য অনেক সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা মোকাবিলার সামর্থ্যের উপরই নিয়মতান্ত্রিক সরকারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। নিচে সাংবিধানিক সরকারের সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো:

 

  • যুদ্ধ: যুদ্ধ বা যুদ্ধের আশংকা নিয়মতান্ত্রিক সরকারের জন্য গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে। কারণ এরূপ সংকট মোকাবিলা করার জন্য সরকার প্রযোজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দাবি করে। সংবিধানের বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে সরকার তখন কাজ করতে চায় না। বস্তুত যুদ্ধ বা যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা দেখা দিলে প্রত্যেক দেশের সংবিধানে সরকারকে জরুরি ক্ষমতা দেয়া হয়। এরূপ অবস্থায় সংবিধানের অনেক বিধান স্থগিত রাখা হয়। এতে সাংবিধানিক শাসনও স্থগিত হয়ে যায়।

 

  • র্থনৈতিক সংকট ও দুর্যোগ:দেশে অর্থনৈতিক সংকট ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে সরকারকে নিজস্ব বিবেচনা মত অনেক ব্যবস্থা নিতে হয়। যেসব দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকট লেগেই থাকে সেই সব দেশের সরকার সব সময় সংবিধানের বাধানিষেধ মেনে চলতে পারে না ।

 

  • স্বৈরাচার: যে কোন ধরনের স্বৈরাচার সাংবিধানিক সরকারের বিপদ বয়ে আনে। রাজতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী, নাসীবাদী ইত্যাদি সরকার অপরিসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়। সংবিধানের বাধানিষেধ মানতে চায় না বলে এসব ধরনের সরকার সাংবিধানিক সরকার নয়।

 

  • জনগণের চিন্তাধারার সাথে সংবিধানের বিরোধ: সংবিধানকে অবশ্যই জনগণের চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির পরিপন্থী বিধিবিধান সংবিধানে নির্দেশিত হলে সাংবিধানিক সরকারের জন্য বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হবে। জনগণ তাদের দুঃখ দুরবস্থার জন্য সংবিধানকে দায়ী করতে চাইবে। এতে সংবিধান এবং এর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে চাপ সৃষ্টিকারী পরিবর্তনের দাবি জানাবে। সংবিধানের ঘন ঘন পরিবর্তন যে কোন নিয়মতান্ত্রিক সরকারেরই স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করবে।

 

######

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button