Good Governance বা সুশাসন বলতে কি বুঝায়?

এ পোস্ট শেষে আমরা জানতে পারবো- সুশাসন কি । সুশাসন কাকে বলে। সুশাসন বলতে কি বুঝায়। সুশাসনের ধারনা। সুশাসনের উপাদান। সুশাসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ কি। সুশাসনের মূল ভিত্তি কি। সুশাসনের উপাদান কয়টি। সুশাসন কিভাবে আইনের শাসন নিশ্চিত করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা কোনটি। সুশাসন অর্থ কি। সুশাসনের অন্তরায় কোনটি। সুশাসনের অন্যতম প্রতিবন্ধক কোনটি

 

Good Governance বা সুশাসন

সুশাসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Good Governance । Good Governance বা সুশাসন সম্পর্কে জানার আগে আমাদের জানতে হবে ‘শাসনের ব্যবস্থা’ বা ‘Governance” আসলে কী। রাজনৈতিক ব্যবস্থায়‘গভর্নেন্সকে’ ‘শাসনের ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ইংরেজি ‘গভর্নেন্স’একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, ক্ষেত্র বা প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ল্যান্ডেল মিলস এবং সেরাজেল্ডিন (Landell Mills and Serageldin)-এর মতে, ‘জনগণ কীভাবে শাসিত হয়, কীভাবে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি পরিচালিত হয়, কীভাবে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় এবং একই সাথে এ সকল প্রক্রিয়া কীভাবে লোকপ্রশাসন ও আইনের সাথে সম্পর্কিত সে বিষয়কেই ‘গভর্নেন্স’ বলে।’

মূলত, গভর্নেন্স প্রপঞ্চটির সাথে ‘সু’ প্রত্যয় যোগ করে Good Governance বা ‍সুশাসন শব্দটির প্রযোগ করা হয়েছে। যার ফলে এর অর্থ দাঁড়িয়েছে নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন।

১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় সর্বপ্রথম ‘সুশাসন’ প্রত্যয়টির ব্যবহার দেখানো হয়। সেখানে উন্নয়নশীল দেশের অনুনয়ন চিহ্নিত করা হয় এবং  বলা হয়, সুশাসনের অভাবেই উন্নয়নশীল দেশে অনুন্নয়ন ঘটেছে। ২০০০ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশ করে যে, Good Governance বা সুশাসন ৪ টি প্রধান স্তষ্কের ওপর নির্ভরশীল।

সেগুলো হলো-

১. দায়িত্বশীলতা

২. হচ্ছতা।

৩. আইনি কাঠামো।

৪. অংশগ্রহণ।

 

Good Governance বা সুশাসনকে একক কোনো ধারণার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত কিংবা বিশ্লেষণ করা যায়না। কারণ, Good Governance বা সুশাসনের ধারণাটি হলো বহুমাত্রিক । বিভিন্ন তাত্ত্বি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থা ‘সুশাসন’ ধারণাটির সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।

Good Governance বা সুশাসনের সজ্ঞায় জি. বিলনে (G. Bilney)- বলেছেন, “Good Governance is the effective management of a country’s Social and economic resources in a manner that is open, transparent, accountable and equitable) ।

মারটিন মিনোগের মতে, “বৃহৎ অর্থে সুশাসন হচ্ছে কতিপয় উদ্যোগের সমাহার ও একটি সংস্কার কৌশল যা সরকারকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলে।

সর্বশেষ বলা যায়, প্রশাসনের যদি স্বচ্ছতা (Transparency), বৈধতা (Legitimacy), জবাবদিহিতা (Accountability) থাকে, এতে যদি অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে, বাক স্বাধীনতাসহ সকল রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে, আইনের অনুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনসভার নিকট শাসন বিভাগের জবাবদিহিতা থাকে তাহলে সে শাসন ব্যবস্থাকে ‘সুশাসন’ বলে।

 

সুশাসনের উপাদান ও বৈশিষ্ট্য

জি. বিলনে এবং UNDP সুশাসনের বেশ কিছু উপাদান ও কার্যকরী বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছে। এখন আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবো-

ক) অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া (Participatory Process) : অংশগ্রহণ বলতে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে জনগণের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনকে বোঝায়। এর অর্থ হলো- রাষ্টের সকল রাজনৈতিক ও শাসন কাজে দেশের জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে।

খ) নৈতিক মূল্যবোধ (Ethics or moral values)- সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ অনেক জরুরী। কারণ, নৈতিকতার সীমানা আইন অপেক্ষা অনেক বেশি প্রসারিত। একটি দেশে নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে শাসন কাজ পরিচালনা করলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

গ) স্বচ্ছতা (Transparency) : সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। স্বচ্ছতার অর্থ পরিষ্কার বা স্পষ্ট। দ্বৈত অর্থবোধতার বিপরীতই হলো স্বচ্ছতা। একটি দেশের শাসন ব্যবস্থার আইন কানুন, নীতি নির্ধারণ যদি স্পষ্ট হয়, এতে যদি একাধিক অর্থ বা ব্যাখ্যা করার সুযোগ না থাকে তাহলে খুব সহজেই তা দেশের জনগণের বোধগম্য হয়। একটি দেশের

শাসক ও শাসিতের মধ্যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও পালনকারীর মধ্যে যদি ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ না থাকে তাহলে খুব সহজেই সুশাসন প্রতিষ্ঠত হয়।

ঘ) বৈধতা (Legitimacy) : একটি দেশের অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী বা সামরিক শাসনকে কখনো সুশাসন বলা হয়না। কেননা তারা দেশের বৈধ শাসক নয়, তাদের গৃহীত নীতি বা সিদ্ধান্ত, প্রণীত আইন বা সামরিক বিধির বৈধতা থাকে না। তাই, সরকারের বৈধতা, সরকারের গৃহীত নীতি বা সিদ্ধান্তের বৈধতা, প্রণীত আইনের বৈধতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আবশ্যকীয় উপাদান।

ঙ) দায়িত্বশীলতা (Responsibility) : সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এখানে দায়িত্বশীলতা বলতে বুঝানো হয়েছে একটি দেশের সরকার ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কর্মকাণ্ডের দায়িত্বশীলতা। সরকারের শাসন বিভাগ তাদের নীতি-সিদ্ধান্ত ও কাজের জন্য আইন বিভাগের নিকট দায়ী থাকে। এভাবে পরোক্ষভাবে শাসন কর্তৃপক্ষ জনগণের নিকটই দায়ী থাকে। কেননা আইন বিভাগের সদস্যগণ জনগণেরই নির্বাচিত প্রতিনিধি ।

চ) আইনের শাসন (Rule of Law) : একটি দেশে সুশাসন তখনেই প্রতিষ্ঠত হয় যখন সে দেশে আইনে শাসন বিদ্যমান থাকে। আইনের শাসনের মুলকথা হলো-  (ক) আইনের দৃষ্টিতে সকলই সমান, (খ) সকলেরই আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ, (গ) শুনানী ব্যতীত কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। আইন হতে হবে সুনির্দিষ্ট, স্পষ্ট ও সহজবোধ্য।

ছ) দক্ষতা (Efficiency): সুশাসনে দক্ষতার অর্থ হলো প্রাপ্ত সম্পদের ও উপকরণের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা অর্জন। একটি দেশে তখনই ‍সুশাসন প্রতিষ্ঠত হয় যখন দেশের জনগন প্রশিক্ষত ও দক্ষ হয়। অবাধ তথ্য সরবরাহ, প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, কর্তব্যবোধ, দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব, কাজের আগ্রহ, কাজে ফাঁকি দেয়ার অভ্যাস, সততা ইত্যাদি বজায় থাকলে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

জ) স্বাধীন বিচার বিভাগ (Independent Judiciary): সরকারের তৃতীয় স্তম্ভ হলো বিচার বিভাগ। একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখতে হবে। বিচার বিভাগের মূল লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। বিচার বিভাগ যদি সরকারের অন্য দুটি বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকলেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং সেখানেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়।

ঝ) সততা (Honesty): সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সততার গুরুত্ব অনেক বেশি। একটি দেশে সুশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই দুর্নীতিমুক্ত হন।  ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থের প্রতি লোভ ইত্যাদি মানুষের জীবনকে অসৎ করে তোলে। কাজেই এগুলো পরিহার না করতে পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

 

ঞ) লিঙ্গ বৈষম্যের অনুপস্থিতি (Absence of Gender disparity): একটি দেশে লিঙ্গ বৈষম্যে থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুশাসনে লিঙ্গ বৈষম্য করা হয় না। নারী পুরুষের মধ্যে যে যোগ্য সে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ পান এবং পুরস্কৃত হন বা পদোন্নতি পান ।

ট) সুশীল সমাজ (Civil Society) – সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকাকে বর্তমানে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। সুশীল সমাজ দেশের জন কল্যাণে কাজ করে। দেশের সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের চেষ্টা করে।  সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিগণ প্রেস, টিভি, রেডিও, আর্থিক সামাজিক ইত্যাদি সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে যে বক্তব্য প্রকাশ করে থাকেন তা’ সুষ্ঠু জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ঠ) প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা (Free Media) : একটি দেশে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে ওই দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠ হয়না। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে, সুশাসনের পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে তাই প্রচার মাধ্যম হবে স্বাধীন ও সরকারের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ মুক্ত।

 

উপরের উল্লেখিত বৈশিষ্ট থেকে বলা যায়, প্রশাসনের যদি স্বচ্ছতা (Transparency), বৈধতা (Legitimacy), জবাবদিহিতা (Accountability) থাকে, এতে যদি অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে, বাক স্বাধীনতাসহ সকল রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে, আইনের অনুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনসভার নিকট শাসন বিভাগের জবাবদিহিতা থাকে তাহলে সে শাসন ব্যবস্থাকে ‘সুশাসন’ বলে।

Back to top button