মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে পড়ছেন ক্যাম্পাসে, লড়ছেন রাকসুতে

এডুওয়াচ ডেস্ক
অদম্য ইচ্ছার কাছে বয়স কখনো বাধা হতে পারে না। সেটিই যেন প্রমাণ করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার মোর্শেদ খান। দীর্ঘ ৩৫ বছরের অচলায়তন ভেঙে চলতি মাসের শেষের দিকে হতে যাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে লড়বেন ৫১ বছর বয়সী এ প্রার্থী।

জানা গেছে, মেয়ে ও জামাতাও পড়ছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য দুটি বিভাগে। বয়স যে শুধু একটি সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়, যেন তা দেখিয়ে দিতেই এবারের রাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন শাহরিয়ার মোর্শেদ।

শুধু নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই নয়, নিজের জয়ের বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ী তিনি। তার আশা, বয়স নয়, সংগ্রামের ইতিহাস ও সততার প্রতিশ্রুতিই তাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে জয়ী করবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এত বেশি বয়সে আর কেউ রাকসু নির্বাচনে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে কখনো অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সম্প্রতি মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মোর্শেদ। কিছুটা ধরে আসা কণ্ঠে বলেন, ‘আমি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বয়স ৫১ বছর হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা আমাকে ভালোবাসেন, অনুপ্রেরণা দেন। তাই বিশ্বাস করি, আমার সংগ্রামী জীবনের গল্পই আমাকে ভোটারদের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। আর জয়ী হলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই কাজ করব।’

শাহরিয়ার মোর্শেদের জীবন যেন অনুপ্রেরণার এক পাঠশালা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে ২০০২ সালে শুরু করেছিলেন উচ্চশিক্ষার নতুন অধ্যায়। কিন্তু পারিবারিক কারণে শেষ বর্ষে ছেড়ে দিতে হয় পড়াশোনা। পরে দীর্ঘ ১৮ বছর চাকরি করেছেন চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তবে ৪০ বছর বয়সে এসে হঠাৎই মনে হলো, ‘স্বপ্ন তো শেষ হয়নি, আবারও হাতে তুলতে হবে পাঠ্যবই।’

সেই ভাবনা থেকেই নতুন পথচলা শুরু। ২০১৭ সালে এসএসসি এবং ২০২০ সালে এইচএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য ফের ভর্তি পরীক্ষা নামের যুদ্ধে অংশ নেন। যার ধারাবাহিকতায় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে।

চার কন্যার জনক মোর্শেদ সম্প্রতি বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এ মেয়েও রাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। আর জামাতা (বড় মেয়ের স্বামী) পড়ছেন পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগে। নিজে শহীদ হবিবুর রহমান হলের, আর জামাতা পাশের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।

নিজের পরিবারকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থিতার খবর জানাননি তিনি। হেসে বললেন, ‘পরিবার এখনো জানে না। তবে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আজ হোক, কাল হোক, তারা জেনে যাবেই।’

জীবনের নানা বাঁকে লড়াই করে এগিয়ে চলা মোর্শেদের কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি মানসিক দৃঢ়তা। তার ভাষায়, ‘আমি একজন সংগ্রামী মানুষ। এ বয়সে এসে তরুণদের সঙ্গে পড়াশোনা করছি। শিক্ষার্থীদের চোখে আমি শুধু সহপাঠী নই, একজন অনুপ্রেরণা। মানসিক শক্তিই মানুষকে স্বপ্নের লক্ষ্য পর্যন্ত নিয়ে যায়, আর আমি সেই লক্ষ্যেই অটল।’

শাহরিয়ার মোর্শেদের রাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার খবরে এরই মধ্যে ক্যাম্পাসে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আজমাইন শাহরিন বলেন, ‘৫১ বছর বয়সী একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, আমি এটিই জানতাম না। এটি অবশ্যই চাঞ্চল্য ‍সৃষ্টির মতো ঘটনা। ভোটটি আমি অবশ্যই তাকেই দেব।’

ইতিবাচক মানসিকতা ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষ যে কোনো বয়সেই নতুন কিছু শুরু করতে পারে, শিখতে পারে এবং নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে—মোর্শেদের প্রার্থিতা যেন তা নতুন করে সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মীর তুহিন বলেন, ‘মোর্শেদ ভাই আমার বিভাগের বড় ভাই। তিনি অত্যন্ত ভদ্র এবং সাদা মনের মানুষ। এ বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত এক শিক্ষার্থী এবং শুধু তা-ই নন; আবাসিক শিক্ষার্থীও। রাকসু নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, এটি যেমন বিভাগের সুনাম বয়ে আনবে, পাশাপাশি ক্যাম্পাসজুড়ে বেশ আলোড়নও সৃষ্টি করবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শাতিল সিরাজ বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৫ বছর পর হতে যাচ্ছে রাকসু নির্বাচন। এমন অনেকেই আছেন, তাদের একজীবনে কখনো রাকসু দেখেইনি। সেই জায়গা থেকে বলব, দীর্ঘদিন পর রাকসু নির্বাচন হওয়ায় দ্বিগুণ উৎসাহ তৈরি হয়েছে। সেই উৎসাহ থেকে আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। শাহরিয়ার মোর্শেদ আমার বিভাগের একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী। তিনিও সেই উৎসাহ থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তার সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিক যে, বয়স বেশি হওয়া সত্ত্বেও ধৈর্যসহকারে এখানে পড়াশোনা করছেন। একই সঙ্গে রাকসুর মতো একটা প্ল্যাটফর্মে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন এবং নেতৃত্ব দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এটিকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।’

/এমআইএইচ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button