মানুষ কেন কাঁদে বা কান্না করে? কান্না কত প্রকার ও কী কী?

কাঁদলে কেন চোখ থেকে পানি পড়ে?

মানুষ কেন কান্না করে

আপনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আপনি কান্না করছেন না তাও কেন আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে? আবার আপনি কোন একটি বিষয় নিয়ে ‍খুব চিন্তিত, অনেক বেশি হতাশায় রয়েছেন, বিষয়টি আপনার মনে বার বার আঘাত করছে। তখনও আপনি লক্ষ্য করেছেন যে আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিন্তু কখনো আপনি ভেবে দেখেছেন এমনটি আসলে কেন হয়?

আসলে অনেক পরিস্থিতির কারণে মানুষ কান্না করে থাকে। এর মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই নিজের অবস্থান ভালভাবে বুঝতে পারে। আমাদের সমাজে অনেকে কান্নাকে ঠাট্টা-উপহাস মনে করে করেন। তাদের মতে, চোখের জল হলো মেয়েলি, প্রশ্রয়পূর্ণ ও অতিনাটকীয় একটি বিষয়। আসলে একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এ ধারণা পুরুষতান্ত্রিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।

আমরা যখন স্কুল-কলেজে পড়েছি তখন শিক্ষকরা আমাদের কান্না করতে নিষেদ করেছেন এবং কান্নাকে সস্তা হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে, মনোবিদরা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, চোখের জল একটি পরিচয় ও মানসিক তৃপ্তি। যার শারীরিক প্রভাব রয়েছে। মনোবিদদের মতে, মানব জীবনে কান্নাকাটি’র প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার, অনেকে কান্নাকে আত্মা পরিষ্কারের ওষুধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

 

কাঁদলে কেন চোখ থেকে পানি পড়ে?

মানুষ কখন এবং কেন কান্না করে?

মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে ‍শুয়ে থাকে তখন তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে দেখা যায়। একজন অসুস্থ ব্যক্তি কান্না না করলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এর প্রধান একটি কারণ হচ্ছে- আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের জীবাণুর সাথে লড়াইয়ের জন্য দেহে শ্বেত রক্তকণিকা সচল হয়ে যায়। এসব সচল শ্বেত রক্তকণিকা চোখের রক্তনালিকে স্ফীত করতে পারে। যার ফলে অসুস্থ ব্যক্তির নালির ছিদ্র ছোট হয়ে যায় এবং নাক নিয়ে পানি না বের হতে পেরে আটকে যায়। পরে আটকে যাওয়া জমে থাকা পানি অশ্রু হয়ে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক প্রতিবেদনে এতথ্য জানিয়েছে।

এ ছাড়া মানুষের মধ্যে যখন গভীর আবেগ তৈরি হয় তখন সেই আবেগ মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর কেন্দ্রীয় স্বায়ত্তশাসিত নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এই নেটওয়ার্ক ২টির মধ্যে ১টি হচ্ছে সহানুভূতি। অন্যটি হচ্ছে প্যারাসিম্প্যাথেটিক।

যখন মানুষের সামনে বিপদ আসে তখন এই নেটওয়ার্ক বুঝতে পারে। অশান্ত মানব শরীরকে শান্ত করতে এই নেটওয়ার্ক কাজ করে। মূলত মানুষের মধ্যে যখন গভীর আবেগ তৈরি হলে তখন সহানুভূতিশীল অংশ সক্রিয় হয়। কিন্তু মানুষ যখন কান্না করে তখন মানুষের মস্তিষ্কের প্যারাসিম্পেথেটিক অংশকে সক্রিয় করে তোলে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন শিশুর সামাজিকীকরণের শুরুতেই তাকে শিখানো হয়- কীভাবে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাকে শিখানো হয়- সমাজের সকলের সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে নেই।

টিভির পর্দায় যে কোন কষ্টের সিনেমা দেখে কান্না করা সমাজের সামনে স্বাভাবিক। কিন্তু কোন কাজের ক্ষেত্রে মন খারাপ বা কষ্টে কান্না করা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেকটা কম্পিউটার প্রসেসরের মতো হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক। একসাথে অনেকগুলো প্রোগ্রাম চালু করলে যেমন ঠিকমতো কাজ করার জন্য কম্পিউটার টাস্ক ম্যানেজার অতিরিক্ত প্রোগ্রাম ফেলে দেয়। তেমনি, মানুষের মধ্যে যখন অতিরিক্ত হতাশা, দু:খ আসে তখন কান্নাও এসব অতিরিক্ত অনুভূতি বের করে মানুষের মস্তিষ্ককে শান্ত করে তোলে।

 

কান্না কত প্রকার ও কী কী?

কান্না সাধারণ তিন ধরনের হয়ে থাকে বা তিন ধরণের চোখের পানি রয়েছে। সেগুলো হলো-

  • বেসাল কান্না।
  • রিফ্লেক্স কান্না।
  • আবেগের কান্না।

 

বেসাল কান্না কি বা কাকে বলে?

এ ধরণের কান্না কাঁদতে হয় না বা চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয় না। এ ধরনের কান্নায় অশ্রু সবসময় চোখের ভেতরেই থাকে। এটি এমন এক ধরণের পিচ্ছিল তরল যা সব সময় মানুষের চোখকে ভেজা রাখে। এই পিচ্ছিল তরলের কারণে কখনো মানুষের চোখ একেবারে শুকিয়ে যায় না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের চোখ প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ আউন্স বেসাল কান্না তৈরি করে।

 

রিফ্লেক্স কান্না কি বা কাকে বলে?

বাসায় কখনো আপনি নিজে অথবা অন্যকেউ পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি পড়ার দৃশ্য লক্ষ্য করেছেন? যদি লক্ষ্য করে থাকেন তাহলে রিফ্লেক্স কান্না হলো এমন ধরনের কান্না।

যে কোন ধরনের আকস্মিক আঘাত, কোন যন্ত্রণা বা সংবেদনশীল কোন বস্তু থেকে চোখকে রক্ষা করাই হলো রিফ্লেক্স কান্নার কারণ। এ কান্নায় কোন মানুষকে কাঁদতে হয় না। যখন প্রয়োজন পড়ে তখন নিজ থেকেই টপটপ করে চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে।

রাস্তার ধুলো, প্রচণ্ড বাতাস, ধোঁয়ার কারণে রিফ্লেক্স কান্না আসে। চোখের কর্নিয়া সংবেদী স্নায়ুর মাধ্যমে যখন কোন বিপদ বা আঘাতের সংকেত পায় তখন সংবেদী স্নায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মস্তিষ্কে খবর পাঠায়। মস্তিষ্ক খবর পেয়ে চোখের পাতায় দ্রুত বিশেষ হরমোন পাঠায়। আর এ কারণেই রিফ্লেক্স কান্না তৈরি হয়।

 

আবেগের কান্না কি বা কাকে বলে?

মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে সেরেব্রাম। সেরেব্রামকে বলা হয় ‘গুরুমস্তিষ্ক’। এই সেরেব্রাম থেকে আবেগের কান্না শুরু হয়। মানুষের সকল ধ্যাণ ধারণা, চিন্তা ভাবনা, মূল্যায়ন, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি সেরেব্রামে থাকে।

মানুষের চোখে অন্তঃক্ষরা তন্ত্র হরমোন পাঠায়। এই হরমোন পানি হয়ে চোখের ভেতরে থাকে। যখনই মানুষ কোন বিষয় হতাশা, কষ্ট বা আঘাত পায় তখন কান্না, বেদনা, আঘাত বা শোকে থাকি তখন এ জল কান্না হয়ে চোখ দিয়ে পড়তে শুরু করে।

 

কান্নার উপকারিতা

আপনি জানলে অবাক হবেন যে কান্নার অনেক উপকারিতা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অল্প সময়ের জন্য কান্না স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। নিম্নে কান্নার উপকারিতা আলোচনা করা হলো-

 

জীবাণুমুক্ত চোখ

একটানা মানুষ কান্না করলে চোখের মধ্যে লুব্রিকেট হয়ে যায়। এ কারণে চোখ সংক্রমণ ব্যাধি রক্ষা পায়। এছাড়া কান্না করলে নেত্রনালী সতেজ হয় এবং চোখে আরাম পাওয়া যায়।

 

আবেগের কান্না

আবেগাক্রান্ত হয়ে কান্নাকাটি করা যে কতটা উপকারি, হয়তো আগে কখনো ভাবতেও পারেননি আপনি! বলছি, শুনুন, কর্টিসল ও অন্যান্য টক্সিনের মতো স্ট্রেস হরমোনের কারণে এ ধরনের অশ্রুবান নেমে আসে চোখে। তাই কান্নার মধ্য দিয়ে আপনি আসলে ক্ষতিকর ওই হরমোনগুলো শরীর থেকে বের করে দিয়ে ফুরফুরে হয়ে উঠতে পারবেন।

 

নিজেকে শান্ত করার ওষুধ

কান্নাকে মনোবিদরা সবসময় ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনা করেছেন। তাদের মতে, নিজেকে শান্ত এবং প্রশমিত করার অন্যতম সেরা উপায় হচ্ছে কান্না। কান্না নিজেকে শান্ত করে আবেগ নিয়ন্ত্রণ আনে। এটি প্যারাসিমপ্যাথিক নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় করে। এরফলে শরীর বিশ্রাম পায় ও হজমশক্তি বাড়ে।

 

বেদনাবিনাশী

কান্না করলে মানুষের বেদনা কমে যায়। দীর্ঘ সময় কান্না করলে শরীর থেকে অক্সিটসিন ও এন্ডোজেনাস ওপিওড নির্গত হয়।

 

মন-মেজাজ ফুরফুরে

গবেষণায় দেখা গেছে, কান্না মানুষের মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়। কান্না করলে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা কমে এবং অক্সিজেন গ্রহণ ক্ষমতা বাড়ে।

##########

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button