ভাব-সম্প্রসারণ কাকে বলে? ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম।

ভাব-সম্প্রসারণ কি?

ভাব-সম্প্রসারণ

ভাব-সম্প্রসারণ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। আমরা প্রায় ৬ষ্ট থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত ভাব-সম্প্রসারণ কাকে বলে? বা ভাবসম্প্রসারণ লিখার নিয়ম শিখি। কিন্তু সঠিক নিয়ম না জানার ফলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আজকের আলোচনায় আমরা সম্পূর্নরূপে ভাব-সম্প্রসারণ কাকে বলে এবং কিভাবে লিখতে হয় তা জানব।

ভাব-সম্প্রসারণ কাকে বলে?

ইংরেজি ‘Amplification’ বোঝাতে বাংলায় “ভাব সম্প্রসারণ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়। ভাব-সম্প্রসারণ বলতে বোঝায়, কোনো বাক্যাংশ বা গদ্যাংশের মধ্যে যে ভাবটি সংগুপ্ত থাকে, তা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে বলা। অনেক সময় বিশেষ কোনো বাক্য বা কবিতার বিশেষ কোনো পক্তির মধ্যেও ভাব-ব্যঞ্জনা লুকায়িত থাকে। সেই ব্যঞ্জনার মর্মোদ্ধার করে সবিস্তারে তা প্রকাশ করাই হলো ভাব-সম্প্রসারণের তাৎপর্য।

কবি ও শিল্পী তাদের সৃষ্টির মধ্যে ভার-প্রতিমাকে ব্যক্ত করেন; এতে সৃষ্টির সৌন্দর্য ও চাতুর্য প্রকাশিত হয়। অনেক সময় একটি ছত্রে বা একটি বাক্যের মধ্যে গভীর ভাব বীজাকারে অন্তর্নিহিত হয়ে থাকে। ঐ বাক্য বা ছত্রটিকে বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে বহুবিধ বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যাবে এবং তার তাৎপর্য আবিষ্কৃত হবে। সে বক্তব্য এবং বক্তব্যের মধ্যে ফুটমান তাৎপর্যকে বিশদভাবে প্রকাশ করার নাম ভাব-সম্প্রসারণ। মূল ভাবটি বিস্তারের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা হয় এবং তাকে পূর্ণভাবে ব্যক্ত করা হয়। ভাব-সম্প্রসারণের মূল উদ্দেশ্য বক্তব্য ও বিষয়কে বিশদভাবে প্রকাশ করা এবং যুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূল ভাবটিকে শিল্প-সৌকর্যময়তা দান করা।

ভাব-সম্প্রসারণে বিষয়-বৈচিত্র্য

নানা ধরনের বিষয় ভাব-সম্প্রসারণের উপজীব্য হতে পারে। মানব-প্রকৃতির বিচিত্র দিক, ঈশ্বরানুভূতি, প্রকৃতির রূপ-রস ও মহিমা এবং সৃষ্টি-রহস্য ইত্যাদি অজস্র বিষয় ভাব-সম্প্রসারণের জন্যে প্রদত্ত গদ্যাংশে বা পদ্যাংশে থাকতে পারে। অনেক সময় মূল ভাবটি রূপক বা প্রতীকের আড়ালে থেকে যায়। সেসব ক্ষেত্রে রূপক-বিশ্লেষণ বা প্রতীক উন্মোচন করে আসল বক্তব্যটি বুঝিয়ে বলতে হবে।

ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম

ভাব-সম্প্রসারণ লিখতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে-

  • প্রদত্ত বাক্য বা ছত্রগুলো বারবার পড়ে তার অন্তর্নিহিত ভাবটি বুঝে নিতে হবে।
  • উপমা, রূপক প্রভৃতি অলঙ্কার থাকলে তার মধ্যকার মূল বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।
  • ছত্র কিংবা বাক্যটিতে ব্যবহৃত শব্দগুলোকে বিশ্লেষণ করে তাদের প্রয়োগ সার্থকতা বুঝতে হবে এবং অন্তর্নিহিত যুক্তিসূত্রগুলো মনে মনে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতে হবে। মূল ছত্র বা বাক্যের শব্দ ভাব-সম্প্রসারণে হুবহু ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়।

আরও পড়ুন:

ণ-ত্ব বিধানের কয়েকটি নিয়ম

বাংলা শব্দে শ, ষ, স-এর ব্যবহারের নিয়ম

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটির বানানের নিয়ম

    • মূল ভাবের অন্তর্নিহিত যুক্তিগুলোকে সহজ ও সরলভাবে বিশ্লেষণ করার সময় প্রয়োজনবোধে দৃষ্টান্ত, তথ্য এবং প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতির ব্যবহার করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, কোনো অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা যেন না করা হয়।
  • প্রদত্ত বাক্যে বা ছত্রে অনেক সময় উপমা, রূপক প্রভাত অলঙ্কারের প্রয়োগ থাকে। উপমান ও উপমেয় অংশকে বিশ্লেষণ করে দেখানোর জন্য দুটি অনুচ্ছেদ রচনা করা যেতে পারে। একটি অনুচ্ছেদে উপমা-রূপকের অর্থ প্রকাশ এবং পরবর্তী অনুচ্ছেদে সেই অর্থের গভীর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা থাকবে।
  • ভাব-সম্প্রসারণে কেবল মূল ভাবের সূত্রটি অবলম্বন করে তার অন্তনিহিত যুক্তিগুলোকে আনুষঙ্গিক তথ্য, উদাহরণ প্রভৃতির সাহায্যে ভাবের পরম্পরা অনুসারে সাজিয়ে নিতে হবে এবং সেভাবে প্রসারিত করতে হবে।
  • সাধারণ বিষয় (general idea) দিয়ে প্রারম্ভিক বাক্যটি রচিত হয়- এ বাক্যটি যেন দৃঢ়পিনস্ক, শ্রুতিমধুর ও সামান্য অলঙ্কারময় (decorative) হয়। ক্রিয়াপদের ও জটিল বাক্যের ব্যবহার আগাগোড়া সংযত হওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন:

উদাহরণসহ ‘ব’ ফলা উচ্চারণের ৫টি নিয়ম

উদাহরণসহ ‘অ’ ধ্বনির সংবৃত উচ্চারণের ৫ টি নিয়ম

উদাহরণসহ ‘অ’ ধ্বনির বিবৃত উচ্চারণের ৫ টি নিয়ম

  • নির্ভুল উক্তি বা প্রবচন প্রভৃতি ব্যবহারের দ্বারা রচনাটির সৌকর্য বিধান সম্ভব।
  • কঠিন ও সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যবহারে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন; এতে বানান ভুলের সম্ভাবনা থাকতে পারে।
  • ভাব-সম্প্রসারণের আয়তনের কোনো নির্দিষ্ট বা বাঁধাধরা নিয়ম নেই। মোটামুটিভাবে কুড়ি বা পঁচিশ লাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া ভালো।
  • ভাব-সম্প্রসারণে কবি বা লেখকের নাম উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। কবি বা লেখক বলেছেন এ ধরনের উক্তি না করাই সংগত। ব্যাখ্যা ও ভাব-সম্প্রসারণ এক জিনিস নয়। ব্যাখ্যায় মূল বিষয়ের মধ্যে চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে হয়; ভাবসম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ততটা সীমাবদ্ধ হয়ে চলার প্রয়োজন নেই। তবে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যের অবতারণ যেন না হয়।
  • মূল ভাবটি প্রসারণের সময় প্রদত্ত গদ্যাংশ বা পদ্যাংশের বহির্ভূত নানা ধরনের বিষয় অবতারণা করা চলে। যেমন- প্রয়োজনবোধে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা বৈজ্ঞানিক তথ্য সমাবেশ করা যায়; মূল বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপমা বা উদ্ধৃতির ব্যবহার করা চলে। তবে সব সময়েই লক্ষ রাখতে হবে, এগুলো যেন ভাবসত্যকে বিস্তৃতভাবে প্রকাশের অনুকূল হয়। প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক তথ্য সমাবেশ না ঘটলে ভাব-সম্প্রসারণ মনোজ্ঞ বা আকর্ষণীয় হতে পারে না; বরং ভারাক্রান্ত, পূর্বাপর সংগতিহীন ও নীরস হয়ে পড়ে। উদ্ধৃতি দেবার সময় তা নির্ভুলভাবে দেবার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখা দরকার, ভুল ও অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দেওয়ার চেয়ে না দেওয়াই ভালো।
  • ব্যাখ্যার মতো প্রসঙ্গ নির্দেশের প্রয়োজন বা সুযোগ এখানে নেই। কোনো বিশেষ শব্দের টীকা টিপ্পনী দেওয়ার প্রশ্নও এখানে অবান্তর। আবার মনে রাখা দরকার, ভাব-সম্প্রসারণ মানে প্রবন্ধ-রচনা নয়। অতএব, প্রবন্ধের অনুসরণে কলেবর বৃদ্ধির প্রয়োজন এখানে নেই। স্মরণ রাখা দরকার, প্রকৃতির দিক থেকে না হোক, আকৃতির দিক থেকে ব্যাখ্যার সঙ্গেই বরং ভাব সম্প্রসারণের সাদৃশ্য বেশি।
  • উচ্ছ্বাসবিহীন ভাষায় লিখতে হবে। তবে এ ভাষা সাহিত্য-গুণান্বিত হওয়া উচিত। সার-সংক্ষেপ বা বস্তু-সংক্ষেপের মতো নিরলঙ্কার ভাষা ব্যবহারের এখানে প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ুন:

য-ফলা, র-ফলা ও ল-ফলা উচ্চারণের নিয়ম

####

এই পোস্ট থেকে আমরা ভাব-সম্প্রসারণ কি? ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারলাম। পোস্টটি কেমন লাগলো আমাদের কমেন্ট করে জানান। ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button